Proclamation of Bangladesh Photographic Society
ঘোষণাপত্ৰ
বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি
আলোকচিত্রণ একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। সহজ বোধগম্যতা ও নির্ভরযোগ্যতার কারণে আলোকচিত্র বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য। আলোকচিত্রণ আজ এক অত্যাবশ্যক মাধ্যম। বর্তমানে জীবনের সাথে এর সম্পৃক্ততা এত গভীরে প্রথিত হয়েছে যে- আলোকচিত্রণ ব্যতীত আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রাই অকল্পনীয়।
আলোকচিত্রণ বিষয়ক জ্ঞান মূলত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কলার সমন্বিত ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করেই সৃষ্ট । একজন ভালো আলোকচিত্রী হতে হলে প্রয়োজন মানুষের আচার আচরণ, সমাজের পারিপার্শ্বিকতার বিষয়ে সম্যক ধারণা। অধিকতর বোধসম্পন্ন একজন আলোকচিত্রীকে হতে হয় নান্দনিকতা, ব্যবহারিক, প্রায়োগিক, সর্বোপরি সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার বিষয়ে জ্ঞানের অধিকারী। স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশের আলোকচিত্রণ চর্চার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে- ১৯৪০ ইং-র দশক বা তার একটু আগে এ বিষয়ে চর্চা শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক বিত্তশালীর মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসেবে। তাঁদের কেউ আলোকচিত্রণ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন এমনটি জানা যায় না। তথাপি সীমিত কারিগরী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই অনুশীলন চালিয়ে যেতেন। আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ’র স্মৃতিকথা থেকে ১৯৫০ ইং এ ‘ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব পাকিস্তান (PSP)’ নামে করাচিতে একটি সংগঠনের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। যেটি ছিল ফিয়াপের সদস্য এবং কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তি ও উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের একটি সংগঠন। আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগ নিজে ১৯৫৯ ইং এ এই সংগঠনের আজীবন সদস্যপদ গ্রহন করেছিলেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে PSP এর কোনো শাখা বা অন্য আলোকচিত্রণ সংগঠনের অস্তিত্বের কথা জানা যায় না। অনুমান করা যায় আলোকচিত্ৰণ অনুশীলন সাধারণের জন্য সহজসাধ্য ছিল না ।
বৃটিশ বিমান বাহিনী এবং পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কিছু সংখ্যক আলোকচিত্রণের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান সমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত আলোকচিত্রী ছিলেন। আলোকচিত্রাচার্য প্রথমে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে, পরবর্তীতে ১৯৫৫ খৃষ্টাব্দে প্যান্সডকে চাকুরীকালীন সময়ে ইউনেস্কো ফটো এক্সপার্ট কুর্ট ব্লুম’র কাছে মাইক্রোফিল্মের কাজ, বৃটিশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে ‘হার্টফোর্ড ইনষ্টিটিউট অব টেকনোলজি’ থেকে রিপ্রোগ্রাফি বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ, লন্ডন ইনস্টিটিউট অব রিপ্রোগ্রাফিক টেকনোলজি থেকে MIRT (AIME সমতুল্য) সনদ প্রাপ্তি, বৃটিশ ইনষ্টিটিউট অব ইনকরপোরেটেড ফটোগ্রাফারস্ (IIP) থেকে পেশাদারী যোগ্যতার সনদ অর্জন তাঁকে আলোকচিত্রণ বিষয়ে পদ্ধতিগত শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রজ্ঞাবান করে তোলে।
আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগ ১৯৪৯ইং-১৯৫৫ইং পর্যন্ত পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকুরীকালীন আলোকচিত্রণ বিষয়ে পদ্ধতিগত শিক্ষার মাধ্যমে মৌলিক ধারণা অর্জন করে ছিলেন। বিমান বাহিনী থেকে অবসরের পর করাচীতে প্যান্সডকে ৩ বছরের মত কর্মকালীন সময়ে ইউ এস আই এস’র কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে বাংলা ভাষায় আলোকচিত্রণ বিষয়ক পুস্তকের অভাব বোধ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তিনি প্যান্সডকে চাকুরীকালীন সময়ে কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রথমবারের মতো প্রতিকুলতার সম্মুখীন হন এবং চাকরী থেকে ইস্তফা দেন। পরবর্তীতে BCSIR এ ও পদোন্নতির সময়ে কর্তৃপক্ষ তাঁর কারিগরী শিক্ষার বিষয়টি অজ্ঞতা হেতু বিবেচনায় না নিয়ে সাধারণ শিক্ষা নিয়ে গড়িমসি করেন। তথাপি তিনি সরকারী পর্যায়ে আলোকচিত্রণ বিষয়ক সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকে অবসর গ্রহণ করেন ।
এ সব সংকটের মূলে যে সব কারণ তা হলো স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্র স্বীকৃত কোনো আলোকচিত্রণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্বীকৃত কোনো পাঠক্রম না থাকা। যার জের অদ্যাবধি আলোকচিত্রণ পেশাজীবিদের পোহাতে হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- রাষ্ট্রের সব বিভাগে, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানে ফটোগ্রাফার নিয়োগের ক্ষেত্রে সমরূপ নিয়োগ নীতিমালা পদমর্যাদা, বেতনক্রম পরিলক্ষিত হয় না, বরং বিপরীতে সর্বত্র অসমান অবস্থাই দৃশ্যমান ।
আলোকচিত্রণ অনুরাগীদের জন্য এমন এক অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের নিমিত্তে পেশাদারী যোগ্যতা সম্পন্ন আলোকচিত্রী সৃষ্টির লক্ষ্যে আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগ’র প্রথম প্রয়াস ১৯৬০ খৃষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর ‘বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফী’ স্থাপন। পাশাপাশি মাতৃভাষায় আলোকচিত্রণ শিক্ষার উপযোগী পুস্তক রচনার সুত্রপাত। যা বাংলা ভাষাভাষী আলোকচিত্রণ অনুরাগীদের জন্য মুদ্রিত আকারে আসে ‘আধুনিক ফটোগ্রাফী’ নামে ১৯৭৪ খৃষ্টাব্দে । অনুমান করা যায়- এ দেশে আলোকচিত্রণ আন্দোলনের প্রথম বীজটি রোপিত হয়েছিল ‘বেগার্ট ইনষ্টিটিউট অব ফটোগ্রাফী’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। অঙ্কুরোদগমের পর পল্লবিত হওয়া শুরু ‘আধুনিক ফটোগ্রাফী’র প্রকাশনায়। সুতরাং ‘আধুনিক ফটোগ্রাফী’ কে এদেশে আলোকচিত্রণ আন্দোলনের ‘বীজপত্র’ বললে অত্যুক্তি হবে না ।
নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও আলোকচিত্রণ চর্চার উন্নয়নে আলোকচিত্রাচার্য তাঁর আলোকচিত্রণ সুহৃদদের সমন্বয়ে সংগঠিত হয়ে ১৯৬১ খৃষ্টাব্দে প্রবীন, সৌখীন আলোকচিত্রী গোলাম কাশেম ড্যাডি’র বাসস্থানে একটি ফটোগ্রাফিক ক্লাব গঠনের উদ্যোগ নেন। তদনুযায়ী ১২ আগস্ট ১৯৬২ খৃষ্টাব্দ ‘ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব’ গঠিত হয় । পরবর্তীতে ক্লাবকে একটি জাতীয় ভিত্তিক বৃহত্তর সংগঠনে রূপান্তরিত করার প্রস্তাবে ড্যাডি তাঁর অক্ষমতার কথা জানালে আলোকচিত্রাচার্য তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন গড়ার প্রয়াসে সংগঠিত হওয়ার ধারা অব্যাহত রাখেন। ইতোমধ্যে দেশের রাজনৈতিক ডামাডোল, পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ইত্যাদির কারণে জাতীয় ভিত্তিক সংগঠনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে আসে ।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ও ‘বেগার্ট’ এ আলোকচিত্রণ শিক্ষাদান অব্যাহত থাকে ৷ এখানে একটি ব্যাপার অনুধাবনযোগ্য যে ‘বেগার্ট’ এর কোনো শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ পরবর্তীতেও ‘বেগার্ট’ এর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন না হওয়া। এ যেন গুরু শিষ্যের ‘নাড়াবান্ধা’ সম্পর্কের মত । আজীবনের সম্পর্ক । আলোকচিত্রণ বিষয়ে যে কোনো সমস্যায় সদা উন্মুক্ত দ্বার ‘বেগার্ট’ এর। এখানে শিক্ষাদানের সাথে থাকতো বাংলাদেশে আলোকচিত্রণের উন্নয়ন ও প্রসারের আন্দোলনের জন্য উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে সচেতন কর্মীবাহিনী সৃষ্টি। প্রক্রিয়াটি অনেকটা এ রকম- আলোকচিত্রণের তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজে সমৃদ্ধ হোন এবং লব্ধ জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করণ । আলোকচিত্রাচার্য যে ভাবাদর্শ অন্তরে লালন করতেন সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তা হল ‘আলোকচিত্রণের শিক্ষা বিস্তার, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ ।
আলোকচিত্রাচার্য এম এ বেগ তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন- এ দেশে আলোকচিত্ৰণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে- চর্চা তথা এ পেশাকে মর্যাদার আসনে উন্নীত করে পেশাজীবিদের উন্নয়নে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু থেকেই-সচেষ্ট থেকেছেন। সে প্রেক্ষিতে ৬ মে, ১৯৭৩ ইং বেগার্টের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ভূমি, বন ও পশুসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন এবং বাংলাদেশে অবহেলিত আলোকচিত্রণ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারী সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ ধরনের আশ্বাস বাণী সব সরকারের আমলে এসেছে- বাস্তবে যথা পূর্বং। এ বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি আলোকচিত্রণ অনুরাগী ও পেশাজীবিদের সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমেই শুধু তাদের প্রত্যাশা এবং দাবী বাস্তবায়ন সম্ভব। তারই ধারাবাহিকতায় একটি জাতীয় আলোকচিত্রণ সংগঠন গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে ২১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ই ‘বেগার্ট’ এর ১৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর সভায় আলোকচিত্রণ অনুরাগী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রন জানান । দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আমন্ত্রন জানানো হলেও বস্তুত তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তথাপি অনুষ্ঠানে আগত আনুমানিক ২৫ জনের মতো আলোকচিত্রণ অনুরাগীদের সামনে বাংলাদেশে আলোকচিত্রনের উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্যে একটি জাতীয় ভিত্তিক শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার আহবান জানান । সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব গৃহীত হলে গঠনতন্ত্র প্রনয়নের জন্য এম এ বেগকে আহবায়ক মনোনীত করে একটি কমিটি গঠিত হয়। ‘বেগার্ট” এর ছাত্র মোঃ মাকসুদুল বারী’র প্রস্তাবক্রমে সংগঠনের নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস)’।
গঠনতন্ত্র প্রনয়নের কাজ সম্পন্ন হলে ৩০ মে ১৯৭৬ খৃষ্টাব্দ তারিখের সভায় খসড়া উপস্থাপিত হয়। এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গঠনতন্ত্রের অনুমোদন লাভ এবং ১২ জন সদস্যের স্বাক্ষরের মাধ্যমে গৃহীত হয়। গঠনতন্ত্রে স্বাক্ষরকারী ১২ জন হলেন যথাক্রমে ১. মনজুর আলম বেগ, ২. ডাঃ আনসার উদ্দীন আহম্মদ, ৩. আবদুল্লাহ্ হারুন পাশা, ৪. মোঃ মাকসুদুল বারী, ৫. বিজন সরকার, ৬. মতিউর রহমান, ৭. নুরুল আজফার (তোতা মিয়া), ৮. কুতুব উদ্দিন, ৯. ইকবাল হোসেন, ১০. জাহাঙ্গীর সেলিম, ১১. সাইদুর রহমান, ১২. সাইফুল হক (টনি)। আবদুল্লাহ হারুন পাশাকে সভাপতি এবং মনজুর আলম বেগ’কে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করে গঠিত হয় প্রথম কমিটি । আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের আলোকচিত্রণ অনুরাগী ও পেশাজীবিদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন; বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (বিপিএস)।